জাপানের রাজধানী টোকিওর শহরতলীর একটি ছোট্টো শহর কাওয়াগুচি। রোববারের বৃষ্টিস্নাত সকালে শহরের অধিবাসীরা যে যার মতো বাহারি রংয়ের ছাতা নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। জীবন এখানে খুব নিরিবিলি। শীত হয়ে গ্রীস্ম এই শহরে আসে খুব অনাড়ম্বর ভাবে। শহরের এক প্রান্তের একটি বারের দিকেও কেউ কেউ যাচ্ছেন। বারের দরজাটির সামনে লেখা জুন ব্রাইড। গত পঁচিশ বছর ধরে সাইতামা অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে এটাই একমাত্র স্থানে যেখানে কিছুটা সময় নিরিবিলি অতিক্রম করা যায়।
দীর্ঘদিনের এই পরিচিত বারটির বাইরের চেহারায় সামান্য পরিবর্তন আসলেও এর ভেতরে এসেছে আমূল পরিবর্তন। আগের বার ও মঞ্চের জায়গায় এখন ভিন্নধর্মী আসবাব বসানো হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন এই বারটিতে শুধু মদ খাবার জন্যই মানুষ আসতো। কিন্তু এখন যারা মদ খেতে ভালোবাসেন তারা শতহাত প্রায় দূরেই থাকেন জুন ব্রাইডের। কারণ জুন ব্রাইড আর এখন মদ বিক্রির কোনো দোকান নয়, উল্টো এটি বর্তমানে একটি উপাসনালয়।
জুন ব্রাইডের দরজা দিয়ে সর্বশেষ যিনি প্রবেশ করলেন তাকে সবাই সেনসি তাতসুয়া সিন্দো নামেই চেনে। তিনি ঘরে ঢুকেই নিজের দুহাত তুলে সবার জন্য মুহূর্তের মধ্যে প্রার্থনা করে নিলেন। ৪৪ বছরের সিন্দোকে দেখলে এখনও তরুণ মনে হয়। তার লম্বা চুল আর ঠোটে লেগে থাকা হাসি সকলের হৃদয়কে শান্ত করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
সিন্দো যখন তার অতীতের কথা তুলে মানুষকে সুন্দর পথে চলার কথা বলেন তখন মানুষের বুঝতে বাকী থাকে না, সিন্দো তার জীবনের সত্যিটা জেনে গিয়েছে। আজ সিন্দোর চারপাশে যারা ভিড় করে ধর্মকথা শুনছে তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের সঙ্গে অতীত জীবনে সিন্দোর মারামারির সম্পর্ক ছিল। অথচ এখন তারা সকলে মিলে ঈশ্বরের প্রার্থনা করছেন। সিন্দোর ভাষ্যে, ‘আগে আমরা প্রতিপক্ষ গ্যাংয়ের ছিলাম। আর এখন আমরা একই ঈশ্বরের প্রার্থনা করি।’
জাপানের অধিকাংশ তরুণের মতোই মাত্র ১৭ বছর বয়সে মাফিয়া গ্যাং ইয়াকুজাতে যোগ দিয়েছিলেন সিন্দো। ‘আমি নিতান্ত শিশু ছিলাম। অতটা গভীরভাবে ভাবার সময় পাইনি। তবে ইয়াকুজাকে আমি ধন্যবাদ দেই এই কারণে যে আমার স্বরুপটা চিনতে পেরেছে। তাদের অনেক অর্থ আছে এবং বিলাসবহুল কায়দায় তাদের জীবন চলে। খারাপ মানুষদের আমার চোখে বেশ লাগে।’
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রতি বছর দশ হাজারেরও বেশি জাপানি তরুণ ইয়াকুজাতে যোগ দেয়। সিন্দোর মতে, এই কম বয়সী তরুণদের অধিকাংশই আসে ঝামেলাপূর্ণ পরিবারগুলো থেকে। আনুগত্য আর বিশ্বাস হলো ইয়াকুজা পরিবারের অন্যতম অস্ত্র। কিন্তু সিন্দো যতই এই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলেন ততই বুঝতে পারলেন রক্তের দাম কতটা।
‘আমার বসকে হত্যা করা হয়েছিল। ক্ষমতার ভাগাভাগিতে অনেক মানুষ মারা যায়। মানুষের পায়ে গুলি করে অকেজো করে দেয়া হয়। আমার সঙ্গেই যে মানুষটি মাদক সেবন করতো, সে বিষক্রিয়ায় মারা যায়। আত্মহত্যাতো হচ্ছেই। অনেক মৃত্যু দেখেছি আমি। যে মানুষটি অন্যকে হত্যার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাকেও ছুরিকাঘাতে মরতে দেখেছি আমি।’
সিন্দোর পুরো শরীরে তার অতীত জীবনের অনেক চিহ্ন আজও রয়ে গেছে। তার বুক এবং হাতদুটো ভারি ট্যাটু দিয়ে ভর্তি। জাপানে মাফিয়াদের সদস্য হলে এরকম ট্যাটু একে দেয়া হয়। তবে সাধারণ মানুষ যাতে এই ট্যাটু না দেখতে পায় তাই মাফিয়া সদস্যরা তা লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু যখন অন্য গ্যাংয়ের সঙ্গে লড়াই বাধে তখন সকলেই তাদের গায়ের পোশাক খুলে ফেলেন।
মোট সাতবার গ্রেপ্তার করা হয় সিন্দোকে। বয়স ২২ হবার আগেই তিনি তিনবার কারাগারে গিয়েছিলেন। ৩২ বছর বয়স আসতে আসতে জীবনের প্রায় দশ বছর কারাগারে কাটিয়ে দেবার পর ইয়াকুজার আরও ভেতরে চলে যান তিনি। কিন্তু কারাগারে থাকাকালীন সময়ে তার মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসে। সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি মাফিয়া জগত থেকে চিরদিনের জন্য ছুটি নেন এবং একজন ধর্মগুরু বা ধর্মযাজক হিসেবে জীবন অতিবাহিত করার সিদ্ধান্ত নেন।
সিন্দোর কাছে এখন বিভিন্ন ধরনের মানুষ আসে। এদের মধ্যে অনেকেই ডিভোর্স হয়ে যাওয়ায় বেদনাক্রান্ত, কেউ সর্বসান্ত হয়ে গেছেন। এমনটি যেসকল পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে হারিয়ে ফেলেছেন তারাও আসেন। আজ সিন্দোর কাছে সাধারণ মানুষ একটু আশার জন্য আসেন। সিন্দো তার সাধ্যমতো তাদের সাহায্য করেন কোনো বিনিময় ছাড়াই।
জাপানে সিন্দোর মতো আরও অনেকেই আছেন যারা এক জীবনে প্রচণ্ড দৌড়ঝাপের জীবন অতিবাহিত করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাইলে তাকে হয় হত্যা করা হয়েছে নতুবা গোটা জীবনের জন্য শারিরীকভাবে অকেজো করে দেয়া হয়। খুব কম সংখ্যক তরুণই আছেন যারা মাফিয়াদের ছেড়ে দেবার পরেও অক্ষত থাকেন। অবশ্য সিন্দোর ক্ষেত্রে এরকম ঝামেলা হয়নি, কারণ ইয়াকুজায় একদিকে সিন্দোকে যেমন সবাই ভয় পেত তেমনি সম্মানের চোখেও দেখতো। জীবনের এরকম একটি অবস্থায় সিন্দো যখন হানাহানির রাস্তা ত্যাগ করে ধর্মের পথে হাটতে চাইলেন তখন তাকে বাধা দেয়া হয়নি।
No comments:
Post a Comment