পৃথিবীর বেশীরভাগ সংস্কৃতিতে ধরে নেওয়া হয় মৃত্যু একজন মানুষকে কেড়ে নেয় তার আত্মীয় এবং বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার তোরাজান গোত্রের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই আলাদা। মৃত্যুর পরেও তারা দিনের পর দিন সযত্নে আগলে রাখে প্রিয়জনের মৃতদেহ। কিন্তু কেন? গা ছমছমে এই সংস্কৃতির কথা পড়ুন আজকের এই ফিচারে।ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে বাস করে এই তোরাজান মানুষেরা। মৃত্যুকে তারা খুব অদ্ভুতভাবে বিচার করে। মৃত্যুর পর সপ্তাহ, মাস এমনকি বছর ধরে তারা একটি মানুষের মৃতদেহকে রেখে দেয় পরিবারের সাথেই। রীতিটিকে বলা হয় রাম্বু সোলোক। যতদিন না পরিবারের মানুষ সমাধিস্থ করার মতো টাকা জোগাড় করতে পারে, ততদিন মৃত মানুষটি বাড়িতে থেকে যায়। এই সময়টায় তাকে মৃত নয় বরং অসুস্থ বলেই ধরা হয়।
৩ বছর বয়সী সিয়ারিনি তানিয়া তিরান্দা মারা গেছে একদিন আগে। কিন্তু তার আপন ও মাসতুতো-পিসতুতো বোনের এখনো তাকে আগলে রেখেছে। তাদের কাছে মেয়েটি মৃত নয়, বরং তো মাকুলা, বা অসুস্থ মানুষ।এই প্রক্রিয়ার মাঝে সেই মৃত মানুষটির জন্য প্রার্থনা করা হয়, এমনকি তাকে খাবারও দেওয়া হয়। কিছু সময়ের পর তাদেরকে সমাধিস্থ করানো হয় বটে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদেরকে দ্বিতীয়বার সমাধিস্থ করা হয়, যে অনুষ্ঠানকে বলা হয় মা’নেনে’। এই সময়ে পরিবার এই মৃত মানুষের শরীর পরিষ্কার করে, তাদেরকে নতুন পোশাক পরায় এমনকি তাদেরকে নিয়ে হেঁটে বেড়ায় এলাকাজুড়ে।
ডেবোরা মাওপা'র মৃতদেহ পরীক্ষা করছেন তার আত্মীয়েরা। ২০০৯ সালে ৭৩ বছর বয়সে মারা গেছিলেন তিনি। তোরাজান মানুষেরা বিশ্বাস করে, পানি ও ফর্মালডিহাইডের ব্যবহারে ভালোয়াবে সংরক্ষিত একটি মরদেহ পরিবারের সৌভাগ্য বয়ে আনে।তোরাজানের অনেক পরিবারের মানুষ দেশের অন্য জায়গায় থাকে। এই অনুষ্ঠানের সময়ে পুরো পরিবার একত্রিত হয়। এই ব্যাপারটাকে উৎসবের মতো করেই দেখে তারা। এই সময়ে বিভিন্ন দেশের ট্যুরিস্টরা এখানে আসে। কোনো পরিবারের এই অনুষ্ঠানে যদি ট্যুরিস্ট উপস্থিত থাকে তাহলে তারা নিজেদেরকে সম্মানিতই মনে করে।
২০১১ সালে মৃত ক্রিস্টিনা বান এর মৃতদেহ তুলে ধরেছে তার ছেলে, বার্তোলোমিউ বুঙ্গা। আর সামনে দাঁড়িয়ে ছবির জন্য পোজ দিচ্ছে ক্রিস্টিনার নাতি, জেরি পুত্রা বুঙ্গা।অদ্ভুত হলেও সত্যি, পাগান ধাঁচের এই অনুষ্ঠানের মাঝে আবার খ্রিষ্টের প্রার্থনা এবং বাইবেলের কথা আওড়ানো হয়। ইন্দোনেশিয়ার বেশীরভাগ অঞ্চলে মুসলিমদের প্রাধান্য থাকলেও ১৬শ শতক থেকে তোরাজান সংস্কৃতির মাঝে জড়িয়ে আছে খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব। এর পেছনে ডাচ মিশনারিদের অবদান আছে বলে ধরা হয়।তোরাজানদের এই রীতি কতদিন ধরে পালিত হয়ে আসছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ এদের এই সংস্কৃতি মূলত মানুষের মুখে মুখে বংশ থেকে বংশে সঞ্চারিত হয়। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা একটি প্রাচীন তোরাজান কফিনের অংশ নিয়ে কার্বন ডেটিং প্রক্রিয়ায় দেখেন, তা এতোই পুরনো যে হাজার বছর ধরে এই রীতি পালন হয়ে আসাটাও বিচিত্র নয়।তোরাজান মানুষেরা এই ব্যাপারে গুরু মানে পেট্রাস কামবুনো নামের এক বয়োবৃদ্ধকে। তিনি দাবি করেন তার বয়স ৯০। অনেকটা আদম ও ইভের থেকে পৃথিবীর মানুষ সৃষ্টি হবার মতোই এক গল্প পাওয়া যায় তার মুখে। তোরাজান বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষ মারা যাবার পরেও তার সাথে পরিবারের সম্পর্ক ছিন্ন হয় না। জীবনের বিশাল ক্যানভাসে মৃত্যু মানে হলো একটা ছোট্ট ফোঁড় খুলে যাওয়া, আর কিছুই নয়। এভাবেই একজন পূর্বপুরুষের বদলে আসে একজন উত্তরপুরুষ, আর চলতে থাকে জীবন মৃত্যুর চক্র।
No comments:
Post a Comment