পৃথিবীতে কিছ কিছু আশ্চর্য জিনিস আছে, আমাদের বাংলাদেশে বসে সেগুলোর কথা শুনলে কল্পকাহিনীই মনে হবে। এর একটি হচ্ছে জার্মানির বিখ্যাত মাগডেবুর্গ জলসেতু। যেখানে সড়ক পথের ফ্লাইওভারের মতো একটি নদীর ওপর দিয়ে আরেকটি নদীকে প্রবাহিত করে দিয়েছেন জার্মান বিজ্ঞানীরা। নিজ চোখে না দেখলে জার্মানির মাগডেবুর্গ জলসেতুটির কথা সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন।ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, গত আঠারো শতক পর্যন্ত জার্মানি কল্পনা করেছে এ সেতুর কথা। আর উনিশ শতকে এসে তারা প্রথম তাদের কল্পনাকে পরিকল্পনায় রূপ দেয়ার কথা ভাবে। ১৯৩০-এ এসে জার্মানি এ সেতুর বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে। কিন্তু এর ভেতর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে সেতুর কাজ তেমন একটা এগোতে পারেনি। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি নামে দুটি দেশ বিভক্ত হয়ে গেলে সেতুটির কাজ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এর কারণ হচ্ছে যে, মাগডেবুর্গ হচ্ছে বার্লিনের পাশের একটি ছোট শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ হয়ে গেলে এলবে-হাভেল নদীটিও ভাগাভাগি হয়ে যায় দু জার্মানির ভেতর। পরে দু জার্মানি একত্রিত হলে ১৯৯৭ সালে এসে সেতুটির কাজ আবারো শুরু হয়। সেতুটির কাজ শেষ হয় ২০০৩-এর অক্টোবরে। সেতুটি চালুও করা হয় ২০০৩ সালেই।
মাগডেবুর্গ জলসেতুটি নির্মাণের পরিকল্পনাটা আসে মূলত এলবে- হাভেল নদীকে মিত্তেলল্যান্ড নামক আরেকটি নদীর সাথে সংযুক্ত করতে গিয়ে। কারণ, মিত্তেলল্যান্ড নামের নদীটি মাগডেবুর্গ অংশে এলবে-হাভেল নদীর পাশ ঘেঁষে গিয়ে ১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এলবে নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এর ফলে জাহাজগুলোকে ১২ কি.মি. ঘুরে একটি থেকে অন্যটিতে যেতে হত। এখন এলবে-হাভেল নদীর ওপর দিয়ে মাগডেবুর্গ সেতুটি হওয়ার ফলে সে ১২ কি.মি. পথ ঘুরতে হয় না বরং মিত্তেলল্যান্ড নদী থেকে এসে যেকোনো জাহাজ আরোহণের পথে নিচে নেমে যেতে পারে এলবে-হাভেল নদীতে। অপরদিকে এলবে-হাভেল নদী দিয়ে চলাচলকারী জাহাজগুলোও কিছুটা ঘুরে গিয়ে মিত্তেলল্যান্ড নদীতে ওঠে যেতে পারে। এছাড়া দুটি নদীকে সংযুক্ত করা হয়েছে আরো দুটি অতিরিক্ত লিফটের মাধ্যমে। ওই লিফটযোগে এলবে-হাবেল নদী থেকে জাহাজগুলো ওঠে যেতে পারে ওপরে অথবা মিত্তেলল্যান্ড নদী দিয়ে আসা জাহাজগুলো নেমে যেতে পারে এলবে নদীতে। এ সেতুর কল্যাণে বর্তমানে জার্মানি জাহাজ চলাচলে প্রচুর সময় সাশ্রয় করছে আর জ্বালানি সাশ্রয় তো আছেই। কারণ এ সেতুটির মাধ্যমেই বার্লিনের সমস্ত খালকে এনে রাইন নদীর মাধ্যমে মাগডেবুর্গ সেতু নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। এ সেতুটি তৈরি করতে জার্মানি ব্যয় করেছে মোট ৫০০ মিলিয়ন ইউরো। সেতুটির নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ২৪০০০ টন স্টীল এবং ৬৮০০০ কিউবিক মিটার কংক্রিট। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৯১৮ মিটার, প্রস্থে এটি ৩৪ মিটার। পানির উচ্চতা ৪.২৫ মিটার সবসময় (সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত)।
মাগডেবুর্গ জলসেতু নির্মাণের আগে ১০০ বছর ধরে ওই সেতু নিয়ে গবেষণা করেছিলেন জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানীরা। তারা আশঙ্কায় ছিলেন একটি নদীর ওপর আরেকটি নদীকে বইয়ে দেওয়ার পর সেতুটি পানি এবং জাহাজের ভার একসঙ্গে বইতে পারবে কি না? গবেষণায় তারা দেখতে পান, একটি জাহাজ পানির ওপর দিয়ে যাবার সময় ততটুকু পানিকেই সরিয়ে দেয়, যতটুকু ঠিক ওই জাহাজের ওজন। জাহাজ যেহেতু পানিতে ভাসবে তাই সেটা সেতুর ওপর কোনো আলাদা চাপ সৃষ্টি করবে না। এ সূত্রকে কাজে লাগিয়েই তৈরি করা হয় মাগডেবুর্গ জলসেতু।মাগডেবুর্গ জলসেতুই পৃথিবীর একমাত্র জলসেতু যেখানে কৃত্রিম একটি নদীর মাধ্যমে প্রবহমান অন্য দুটি নদীকে একটির সাথে অপরটিকে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে, যা সত্যিই এক বিস্ময়ের। মানুষের কল্পনা যে কখনো কখনো বাস্তবের কাছে পরাজিত হতে পারে, মাগডেবুর্গ সেতু দেখার পর পর্যটকরাও তা স্বীকার করছেন।
No comments:
Post a Comment